“মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততা প্রিয়।“ (সূরা বনী ইসরাঈল:আয়াত-১১)
তুষার ভাই একজন কবুতর খামারি, তিনি অন্য খামারির মত একটু বেশী বুঝে থাকেন। একদিন আমাকে জানালেন যে তার কবুতরের অবস্থা খারাপ কেন? তিনি জানালেন যে তার কবুতরের জ্বর Fever of Pigeon হয়েছিল। আর তার ঔষধ হিসাবে তিনি প্যারাসিটামল খাওয়ায় দিয়েছেন। ফলে কবুতর এখন বমি করছে আর লোম ফুলিয়ে বসে আছে। এখন কি করা যায়। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম তার যে জ্বর হয়েছে আপনি কিভাবে বুঝলেন? তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন যে, গায়ে তাপ অনেক বেশি কত বেশী এই ধরেন ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর ও বেশী। যাইহোক, যদিও সেটা তিনি না মেপেই আন্দাজের উপর বলেছিলেন। উনার মত আমাদের দেশে ৯৫% খামারির কবুতরের জ্বর সম্পর্কে সঠিক ধারনা নাই। আর এক্ষেত্রে প্যারাসিটামল খারাপ ভুমিকা পালন করে থাকে। এটি কিডনি ও লিভারের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে, সকল জীবন্ত প্রাণীদের জন্য, যদিও আমাদের ক্ষেত্রে এটা জ্বরের প্রাথমিক ঔষধ হিসাবে প্রচুর ব্যাবহৃত হতে দেখা যায়। কিন্তু এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের কমই ধারনা আছে।
কোন প্রাণীর শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে অধিক তাপমাত্রা দেখা দিলে তাকে জ্বর বলে আখ্যায়িত করা হয়। একটি কবুতরের শরীরের গড় তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট( ৯৮.৫ থেকে ১০৯.৪ ফারেনহাইট) অর্থাৎ ৩৭ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হৃদয় স্পন্দন স্বাভাবিক ১৮৫ বিপিএম (Beat per minute)। কবুতর জ্বর (Pigeon fever) ও কবুতরের জ্বর (Fever of a pigeon) এই দুইটি কথার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। কবুতর জ্বর (Pigeon fever) সাধারনত ঘোড়ার মধ্যেই দেখা যায়। এটি অন্য প্রাণীর মধ্যে সংক্রমিত হতে দেখা যায় না। অপর দিকে কবুতরের জ্বর সাধারনত রক্তে ক্যালসিয়াম এর প্রচুর ঘাটতির কারনে হয়ে থাকে। চালিকা স্নায়ু বা পেশীগুলোর পাংশুতের কারনে সংবেদনশীলতা বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললে এই রোগ দেখা যায়। আর এটিকে (Milk Fever) বলে। এটি দুগ্ধ প্রদানকারী প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় বেশী। কবুতরের নর ও মাদী দুইতির মধ্যে দুগ্ধ হতে দেখা যায় যাকে (Corp Milk) বলে। আর এই দুধ ১০ দিন পর্যন্ত কবুতর তাদের বাচ্চাদের কে খাওয়ায়। যদিও অজ্ঞানতার কারনে, অনেকেই বলে থাকেন যে বাচ্চা হলে, তাদের পিতামাতাকে ভিটামিন ও মিনারেলস দিতে হয় না ইত্যাদি নানা কথা বলে থাকেন বা এই ধরনের উপদেশ দিয়ে থাকেন। আর যার ফলে এই ধরনের অনাখাঙ্কিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যদিও জীবাণু ঘটিত, রক্তে কোন ধরনের বিষ প্রবেশ করলে, খাবারে ফাঙ্গুস বা বিস্ক্রিয়ার ফলে, বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়টিক বা ঔষধের একসাথে প্রয়োগে বিক্রিয়া জনিত কারনে, হটাত ঋতু পরিবর্তনের বেশী ঠাণ্ডা বা গরমে, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, প্রদাহ বা আঘাত জনিত কারনেও বা মানুষের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে দেখা যায়। ডিম পারার পর মাদী কবুতরের এই ঘটনা বেশী হয়। যদিও নর মাদী দুটির মধ্যেই এই রোগ দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে ব্রীডিং পেয়ারের বাচ্চা খাওয়ানোর সময় হতে পারে বা ঘন ঘন ডিম বাচ্চা করালে ও তাদের যথেষ্ট পরিমান সুষম খাদ্য, ভিটামিন ও মিনারেলস সরবরাহ না করলে।
উপসর্গ বা লক্ষনঃ
১) লোম ফুলিয়ে মাথা গুঁজে ঝিমান, হালকা কাপুনি ভাব থাকতে পারে। ঘন ঘন শ্বাস নিবে। পাখা ঝুলে যাবে ও লেজ নামান থাকবে।
২) ঠোঁট ও মুখ সাদা ফ্যাকাসে বা প্যাংসেটে ভাব বা লাল হতে পারে। তার সাথে বমি ভাব থাকতে পারে। আর মুখে বা বমিতে টক ঘন্ধ থাকতে পারে।
৩) গায়ের তাপমাত্রা ১০৭ ডিগ্রি বা তার বেশী হতে হবে। এজন্য আগে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর পরিমাপ করা দরকার। আর এ ক্ষেত্রে পিছনে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে।
৪) পায়খানা সবুজ সাদা বা সবুজ পাতলা বা সাদা পানির মত হতে পারে।
৫) বাতাস বা ঠাণ্ডা বা আলো পছন্দ করবে না। খাঁচার এক কোনে পা তুলে বা চুপ করে বসে থাকবে অথবা খাঁচার মেঝেতে বসে থাকতে পারে।
৬) আঘাত পা প্রদাহ জনিত হলে সেই জায়গায় ঠোঁট দিয়ে বার বার চুলকান বা সে নিজে মুখ ঘষার চেষ্টা করবে।
৭) হটাত বাচ্চা খাওয়ান বন্ধ করে দিতে পারে বা ডিমে তা দিয়া বন্ধ করে দিতে পারে।
৮) অনেক সময় এই রোগ থেকেই ক্যানিবলিজম রোগের সৃষ্টি হতে পারে আর তা হলে কবুতরের বাবা-মা বাচ্চাদের লোম তুলে রক্ত সহ খেতে দেখা যায়।
৯) এই রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় কবুতরের স্বাভাবিক সেন্স কাজ কম করে হটাত উল্টে পড়ে যেতে পারে, বা হাঁটার সময় কারসাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যাবার মত ঘটনা দেখা যায় যদিও অনেকেই টাল রোগ কে এর সাথে মিক্স করে ফেলতে পারেন এটি দুর্বলাতা এরূপ হতে দেখা যায়।
চিকিৎসা ও প্রতিকারঃ
চিকিৎসা ও প্রতিকারের জন্য এই রোগের ইতিহাস জানা খুন জরুরি অর্থাৎ কেন এটা রোগ হল? এই ঘটনা যদি আপনি সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে পারেন তাহলে আপনার জন্য এর চিকিৎসা ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করা সহজ হয়ে যাবে।
১) CALVIMAX Plus/CALBON Plus/OSTOGEN Plus/MULTICAL/IPICAL-M (Human calcium supliment) যে কোন এক ধরনের ট্যাবলেট ১/২ করে দিনে ২ বার দিতে হবে ৭ দিন। অথবা আপনি যদি ইঞ্জেক্সন দিতে সাছন্দ বোধ করেন তাহলে Calcium Jayson ইঞ্জেক্সন ৩-৪ মিলি করে দিনে ১ বার ৪-৫ দিন দিতে পারেন।
২) বমি সহ জ্বর কবুতর হালকা কাঁপে এমন অবস্থায় হোমিও Ipicac 200, ১-২ ফোঁটা করে দিনে ৩-৪ বার খাওয়াতে হবে, ৪-৫ দিন।
৩) ঘা বা কাটা ছিঁড়ার কারনে বা পর বা নখ কাটতে গিয়ে রক্ত বা অন্য কোন প্রদাহ জনিত জ্বরে হোমিও Belodona 30, ১-২ ফোঁটা করে দিনে ৩-৪ বার খাওয়াতে হবে, ৪-৫ দিন। আঘাত জনিত জ্বরে যেমনঃ- খাচাতে পা আঁটকে ভেঙ্গে গেলে/ কোন আঘাত পেলে ইত্যাদি কারনে জ্বর হলে বা ডিম পারার পর এই অবস্থা দেখা গেলে হোমিও Arnicamont 30,১-২ ফোঁটা করে দিনে ৩-৪ বার খাওয়াতে হবে, ৪-৫ দিন।
৪) যারা হোমিও তে সাছন্দ বোধ করেন না তারা Cotrim-Vet Suspension ১/২ মিলি+স্যালাইন ১/২ গ্রাম=৩-৪ মিলি পানিতে মিক্স করে দিনে ২-৩ বার ৪-৫ দিন দিতে পারেন।
৫) Enflox-Vet Solution ৪-৫ ফোঁটা+১ গ্রাম স্যালাইন=৩-৪ মিলি পানিতে মিক্স করে ২-৩ বার ৩-৪ দিন প্রয়োগ করতে হবে। যদি ৪ নং চিকিৎসাতে ২-৩ দিনের মধ্যে কোন পরিবর্তন না হয়, তাহলেই কেবল এই চিকিৎসা করা যেতে পারে।
যেকোনো রোগেই ধৈর্য অনেক বেশী জরুরি, আর এ ক্ষেত্রেই একজন খামারি বা পালকের সার্থকতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে থাকে। আপনি কখনও ১-২ দিনে রোগের ভালমন্দ বিচার করতে পারবেন না যতক্ষণ না একটা ঔষধের ক্রিয়াকাল বা সময় না দেন। আর যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে নিজের বিচার বুদ্ধি অনেক বেশী দরকার, কারণ আপনি হুট করে সিধান্ত নিতে পারবেন না। যদি না আপনার সেই অভিজ্ঞতা থাকে। আর অযথা বিভিন্ন ধরনের কয়েক পদের অ্যান্টিবায়টিক একসাথে প্রয়োগের ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ কিছু অ্যান্টিবায়টিক একে অপরের সাথে মারাত্মক বিক্রিয়া করে থাকে। বিশেষ করে ESB30 ও Cosomic Plus খামারি বা পালক এমন ভাবে প্রয়োগ করেন যেন কোন ভিটামিন ও মিনারেলস দিতেছেন, অথচ তাদের ধারনাই নাই যে আই দুইটি কয়েক ধরনের অ্যান্টিবায়টিক এর মিশ্রন। যায় হোক, প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ ভাল। তাই এমন পরিস্থিতির আগে সেই অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিলে আপনি আপনার লক্ষেই পৌঁছাতে সহজ হবে। পরিশেষে, কোরআনের আয়াত দিয়ে শেষ করে চাই তাদের জন্য যারা এর মর্ম উপলব্ধি করে,
“(বিপথগামী ওরাই) যারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ পাক যা অবিচ্ছিন্ন রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে, আর পৃথিবীর বুকে অশান্তি সৃষ্টি করে। ওরা যথার্থই ক্ষতিগ্রস্ত।“ (সূরা আল বাক্বারাহঃআয়াত-২৭)
লেখক : সোহেল রাবি ভাই