ভুল সবই ভুল (কবুতর কেস স্টাডি ৪থ পর্ব)

“প্রচুর পরিমাণে আলোচনার মাঝে জ্ঞান নির্ভর করে না, বরং জ্ঞান হলো এমন আলো যা আল্লাহ অন্তরের মাঝে স্থাপন করে দেন।” – ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রা)

আমার গ্রামের বাড়িতে ছোটবেলায় একবার এক মেয়ে পাগল হয়ে গেল হটাত করে! কেউ বলল, মাথা গরম হয়ে গেছে! কেউ বলল, মগজ উল্টে গেছে! কেউ বলল, ভয় পেয়ে এমন হয়েছে! কেউ বলল জিনে ধরেছে! কথাটা শুনে গা ভয়ে কেমন যেন ছম ছম করে উঠল! আমারা কেউ সেই বাড়ির কাছে দিয়ে ভুলেও যেতাম না, আরে জিনে ধরা মেয়ে এই বাসাই আছে। যদি জিন আমাদের দেখে ফেলে, আর মেয়েতিকে ছেড়ে, আমাদের পিছু নেয়। তাহলে? যাই হোক বেশ কিছু দিন পর এক বড় মাপের তান্ত্রিক/দরবেশ যেটাই বলেন পাওয়া গেল খোজ করে। এখন তার ফরমাইশ মত এটা সেটা নিয়ে আশা হল। এখন জিন ছারাবার পালা, জীবনে কখনও জিন ছারান দেখি নাই, তাই ভয় পেলেও একটা কৌতূহল বশে আমরা সবাই গেলাম তথা কথিত জিন ছাড়ান দেখতে। বলে রাখা ভাল, যিনি জিন ছারাবেন তার চেহারা জিনের থেকে কোন অংশে ভাল ছিল না। যাই হোক শুরু হল সেই জটাধারী লোকটির জিন ছাড়ানর কাজ, প্রথমেই অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে শুরু হল, এর পর শুরু হল, ঝাঁটা দিয়ে মাইর, লকে বলে মারের উপর ঔষধ নাই। যাই হোক, এর পর, নাকে মুখে মরিচ গুরা ছিটান, আর সব শেষে, শুকনো পুড়ান মরিচ ২ নাকে গুজে দিয়া হল, আর শুরু হল বড় একটা বাঁশ দিয়ে প্রচণ্ড মার। মারের চটে, অজ্ঞান হয়ে পড়ল মেয়েটি। যদিও পরে মেয়েতিকে হাসপাতালে শেষ পর্যন্ত ভরতি করতে হয়েছিল। কিন্তু সেই ভণ্ড লোকটি দাবি করেছিল যে তার কারনেই জিন তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই যাই হোক, এই ধরনের জিন ছাড়ানর চিকিৎসা আজ গ্রামে গঞ্জে চলে আসছে। এই ধরনের চিকিৎসা যে শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই মানুষ প্রয়োগ করে তা নয়। আজকাল এ রকম কিছু ভণ্ড বাবা মানে কিছু চিকিৎসক কবুতরের চিকিৎসার নামে এই ধরনের আজগুবি সব চিকিৎসা ব্যাবস্থা করে আসছেন। আর আমাদের মত কিছু মানুষ সেগুলো, কোন প্রশ্ন ব্যাতিরেকেই পালন করে যাচ্ছেন। নিজেদের কোন বিবেক বুদ্ধি না খাটিয়ে! কেন? কোন কারন নাই। কবুতরের প্রতি অন্ধ ভালবাসা আমাদের এই ধরনের কাজে উৎসাহিত করে।

“সহানুভূতির ব্যাপারটা সবসময় আপনার কাছ থেকেই শুরু হয়। আপনি নিজেকে যতই ভালো করে খেয়াল করবেন এবং আপনার দুর্বলতাগুলোকে দেখতে পাবেন, অন্যদের ব্যাপারে আপনি ততই কম বিচারপ্রবণ হবেন।”-– তারিক রমাদান

আমাদের দেশে কিছু সাধারন ভুল করে থাকেন, যা কিনা মারাত্মক অথচ আমার কেউ এটাকে আমলেই নেই না। আসুন জেনে নেইঃ

১) আমাদের দেশে ভ্যাকসিন নিয়ে একটা উড়কথা তবে আমি বলব কুসংস্কার আছে। কবুতরের ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক বারই বলেছি, কিন্তু কোন কাজ হইনি। আমাদের দেশেই কেবল হাঁসমুরগির ভ্যাকসিন নিয়ে এত মাতামাতি, যা কিনা বিশ্বের আর কোন দেশে দেখা যাই না।

২) যখন এই ধরনের হাঁসমুরগির ভ্যাকসিনের উপদেশে কান ঝালাপালা, তখন এক শ্রেণীর লোক যারা নিজেদের কবুতর প্রেমি বলে দাবি করে তারা অন্যদের উপদেশ দেন যে ভ্যাকসিন বা অন্য যেকোনো ইনজেকশন ঘাড়ে পুশ করতে। কত মারাত্মক কথা অথচ কত সহজেই আমরা বলে ফেলি। ঘাড়ে ইনজেকশন দিবার জন্য যে জিনিসটা বেশী দরকার তা হল পুশগান, আমাদের দেশে কয়জনের কাছে আছে এই পুশগান? দ্বিতীয়ত নার্ভ সম্পর্কে সঠিক ধারনা। আছে কি তাদের যারা এই ধরনের উপদেশ দেন। বা তারা কি কখনও তাদের নিজের কবুতর কে এ ভাবে পুশ করে করেছেন আর তাতে ভাল ফলাফল পেয়েছেন? নাকি এটা সেয় লেজ কাটা শেয়ালের গল্পের মত যেহেতু তার লেজ কাটা গেছে, এই জন্য সবাইর লেজ কাটতে বলছেন! একজন মনিষীর কথা , “এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না , যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করেনা তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে।“ অ্যালবার্ট আইনস্টাইন

৩) আমারা নিজেদের সর্দি কাশি বা পাতলা পায়খানা হলে কখনও অ্যান্টিবায়টিক ব্যাবহার করি না কখনও কিন্তু কবুতরের বেলায় নির্দ্বিধায় ব্যাবহার করি, কেন? এর জবাব আপনার কাছে, আমার জানা নেই।

৪) সবুজ পায়খানা হলেই সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েন। আসলেই কি সবুজ পায়খানা মানেই যে সাল্মনিল্লা তা ঠিক না। একটা কবুতরের সবুজ পায়খানা অনেক কিছুরই ইজ্ঞিত বহন করতে পারে। যেমন- ক) ভ্রমণ জনিত সবুজ পায়খানা। খ) ভয় পেলে সবুজ পায়খানা গ) কোন রোগের পূর্বাভাস এই সবুজ পায়খানা। ঘ) কোন খাবারের উপয়াদানের কারনে সবুজ পায়খানা। আর তাই আপনাকে মনে রাখতে হবে, সবুজ পায়খানা করলেই যে আপনার কবুতর অসুস্থ তা ঠিক না। যদি না খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে। আর এক্ষেত্রে কেবল আপনি অ্যান্টিবায়টিক প্রয়োগ করতে পারেন তার আগে না।

৫) সাল্মনিল্লার জীবাণু কম বেশী সকল জীবিত প্রাণীর মধ্যেই থাকে, তবে মাত্রাটা কম, যখনি এই মাত্রাটা সহনীয় পর্যায়ের বেশী হয়ে যাই তখনই ভয়ের কারন হয়। আর এটাকে সহনীয় মাত্রায় রাখাটাই হল বুদ্ধিমানের কাজ। তবে মনে রাখবেন সাল্মনিল্লার জীবাণু কখনও ১০০% নির্মূল সম্ভব না। যদিও অনেকেই মনে করেন যে, অ্যান্টিবায়টিক সহ কিছু কোর্স করালে সাল্মনিল্লা ১০০% ভাগ নির্মূল সম্বভ । যারা এসব কথা বলেন তারা হয় আবাগের বশে বলেন বা তাদের কোন সঠিক ধারনা নাই তাই বলে থাকেন। সাল্মনিল্লা কে নিয়ন্ত্রন এর মধ্যে রাখতে পারলেই আপনি সেটা কে সফল বলে ধরে নিতে পারেন। আর আপনাকে সব সময় মনে রাখতে হবে যে, অ্যান্টিবায়টিক কখনও প্রতিরোধের মাধ্যম হতে পারে না। একটা কথা মনে রাখবেন। “যারা সচেতন কেবল তারাই রক্ষা পায়।” – ইমাম ওমর সুলাইমান

৬) অনেক সময় পটার বা কিছু কবুতরের বাচ্চাদের ক্রপ এ বাতাস ভরে যাই, অনেকেই আছেন যারা সাধারণত উপদেশ দেন যে, সূচ দিয়ে ক্রপ টা ফুটা করে বাতাস বের করে দিতে। এই ধরনের চিকিৎসা ব্যাবস্থা শুনলে গায়ের লোম দাড়িয়ে যাই। কিভাবে একজন শিক্ষিত মানুষ এই ধরনের চিকিৎসা ব্যাবস্থা দিতে পারেন। শুধু এটা না এই ধরনের আরও আজগুবি সব চিকিৎসা আছে যা আমার আগের পোস্ট গুলো তে উল্লেখ করেছি। কারা এই ধরনের চিকিৎসা দিচ্ছেন কি তাদের উদ্দেশ্য? এই চিন্তা করার সময় এখনি। বিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এই ধরনের চিকিৎসা ব্যাবস্থা আপনি কততুকু সমর্থন করেন। এটা আপনার চিন্তা ধারার উপর নির্ভর করে।

৭) আমাদের অধিকাংশ খামারি ভাইরা কবুতরের খাওয়া একটু কমিয়ে দিলে, বেশী চিন্তিত হয়ে পড়েন। আর এটা নিয়ে গবেষণায় লেগে পড়েন কেন খাওয়া কমিয়ে দিল? দু একজনের কাছে উপদেশ চান, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ধরনের ঔষধের উপদেশ দেন। আর আমার বিচার বিবেচনা না করেই, এই ধরনের সুস্থ কবুতর কে নানা ঔষধ দিয়ে অসুস্থ করে তুলি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, অতি গরমে বা অতি শীতে মানুষেরই খেতে ভাল লাগে না আর প্রাণী ত দূরের কথা। আমারা খাওয়া নিয়ে যে পরিমান গবেষণা করি বা চিন্তা করি, সেটা যদি রোগ নিয়ে করতাম, তাহলে অনেক সমস্যা আমাদের কমে যেত।

৮) আমাদের আরেক ধরনের খামারি আছেন, যারা কবুতরের পায়খানা হলেই চিন্তিত হিয়ে পড়েন, আরা নানা ধরনের ঔষধ প্রয়োগ শুরু করে থাকেন। আর তা আবার উচ্চ মানের অ্যান্টিবায়টিক, তাতে কি এই রোগ ভাল হয়? না মোটেই না। আর এর ফলাফল কি হয়। কবুতরের ডিম পাড়া বন্ধ হয়ে যাই, ঠিক মত ডিম জমে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কবুতরের ১০০ জন যে সমস্যা নিয়ে আসেন পরে তারা অধিকাংশই থাকে এই ডিম না পাড়া বা ডিম না জমার সমস্যা সম্পর্কে। আমাদের কি কখনও এসব বিষয়ে ভাবার সময় আছে?

৯) আমাদের দেশে অধিকাংশ খামারি আছেন যারা, সস্তাই কবুতর কিনতে চান সব সময়, এর এটা করতে গিয়ে তারা স্বাস্থ্য ঝুকির ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ত দেন না। আর ফলশ্রুতিতে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়। প্রায় শুনা যায় ভাই কালকে হাঁট থেকে ১ জোড়া ভাল কুবুতর বেশ সস্তাই পেলাম তাই কিনে ফেললাম। কিন্তু আজ এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। আপনি যেখান থেকেই কবুতর কেনেন না কেন। আপনার খামারে প্রবেশ করানোর আগে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে আপনাকে, আর সেটা হাঁট থেকেই কেনা বা বিখ্যাত কোন খামারির কাছ থেকেই কেনেন সব ক্ষেত্রেই সতর্কতা একই হতে হবে। আর এটা করতে গিয়ে যদি আপনি কোন প্রকার গাফেলতি করেন, বা আপনার আবেগ কে প্রাধান্য দেন, তাহলে তার জন্য আপনাকেই চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।

১০) চোখের ড্রপ ৫ দিনের বেশী দিতে হয়না। যেকোনো অ্যান্টিবায়টিক ৩-৫ দিনের বেশী দিতে হয় না। অ্যান্টিবায়টিক এর সাথে অবশ্যই গ্লুকস বা স্যালাইন মিক্স করতে হবে। অ্যান্টিবায়টিক এর সাথে কোন প্রকার ভিটামিন মিক্স করা যাবে না। ১-৩ টা রোগের ক্ষেত্র ছাড়া। অ্যান্টিবায়টিক দেয়ার পর রোগ ভাল হলে অবশ্যই প্রবাওটিক দিতে হবে। তা না হলে সর্দি কাশি ও পাতলা পায়খানার মত রোগ বার বার হবে।

আমরা অনেকেই মানুষের ও কবুতরের উপকার করতে গিয়ে মনে করে থাকি বিশাল কিছু করে ফেলেছি। বা যারা এই ধরনের উপকার করেন তাদের প্রসংসা করতে গিয়ে অনেক টা শিরক এর মত করে ফেলি। মনে রাখবেন আল্লাহ্‌ হলেন সকল প্রশংসার অধিকারি। আমারা যেন এই শিরক থেকে বেচে থাকতে পারি। (আমীন)

আজ আল্লাহ্‌ আমাদের তার অশেষ মেহেরবানীতে সেই যোগ্য করেছেন বলেই আমরা আরেকজনের উপকার করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনেকের সেই যোগ্যতা থাকার পরও আল্লাহ্‌ তাদের সেই তৌফিক দেন নি। একটা কথা মনে রাখবেন সব সময়,“আপনার ভালো কাজগুলো আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। আপনার করা ভালো কাজগুলো আপনার নিজেরই প্রয়োজন।” – ড. তারিক রমাদান

পরিশেষে আল্লাহ্‌ যেন আমাদের কে শেষের এই বাক্যটির প্রতি আল্লাহ্‌ যেন আমল করার তৌফিক দান করেন। “আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জন করার চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই। এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য জ্ঞানার্জন করলে তিনি যেমন ঘৃণা করেন তা অন্য কিছুতে করেন না।“– আবদুল্লাহ ইবনে মুবারাক (রাহিমাহুল্লাহ)

মূল লেখক : সোহেল রাবি ভাই

এপ্রিল 12, 2014 7:26 অপরাহ্ন

6357 সর্বমোট দেখা হয়েছে, 0 আজকে